উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে প্রযুক্তির একভূতকরণ ছাড়া রাষ্ট্রের বিকল্প ব্যবস্থা নাই
মঙ্গলবার, ১২ আগস্ট, ২০২৫ ১:২৪ অপরাহ্ন
শেয়ার করুন:
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই যুগে সারা পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতিকরনের কারণে শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে প্রযুক্তির একত্রিকরণের কারণে।
বাংলাদেশের প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসার ঘটাতে আমাদের সচেতনতা ও সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়ার এখনই সময়। বিষয় ভিত্তিক তথ্য ও গবেষণা করে ভবিষ্যতে করণীয় বিষয়গুলোকে তুলে ধরা একান্ত আবশ্যক বলে মনে করলাম।
সর্বশেষ পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে সর্বমোট ১৭০টি বিশ্ববিদ্যালয় (৫৫টি সরকারি এবং ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) তাদের শিক্ষা ও প্রশাসনিক (নতুন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু প্রশাসনিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ রয়েছে) পরিচালনা করছে। এ সব প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন। বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ (শিক্ষার্থী সংখ্যা বিবেচনায়) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত কলেজের সংখ্যা ১৬৮০ যেখানে প্রায় সাড়ে তিন মিলিয়ন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের অন্যতম এই বৃহৎ শিক্ষার্থী সমৃদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত ইউনিভার্সিটি ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও লার্নিং ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম (এলএমএস) ছাড়াই পারিচালিত হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশে বিছিন্ন কোর্স ডেলিভারি, অসঙ্গতিপূর্ণ মান নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষাদান ও শেখার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির সীমিত একীকরণ ও ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। অথচ সরকারের স্ট্রাটেজিক প্ল্যানে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহারকে অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়েছে।
এরূপ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য বাংলাদেশে আধুনিক, নমনীয় এবং বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে জরুরিভাবে একটি ঐক্যবদ্ধ ডিজিটাল অবকাঠামোর প্রয়োজন। বিশ্বব্যাপী, শীর্ষ উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাগুলি ক্যানভাস, ব্ল্যাকবোর্ড বা অনুরূপ আধুনিক এলএমএস প্ল্যাটফর্মগুলিকে কেন্দ্রীভূত, মানসম্মত অনলাইন (ই-লার্নিং) এবং মিশ্র শিক্ষার পরিবেশ প্রদানের জন্য ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের একমাত্র নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কুষ্টিয়ার রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় বিছিন্নভাবে এলএমএস ভিত্তিক সীমিতভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করলেও অদ্যাবধি বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির ব্যবহার ও একীকরণে কার্যকর ও সমন্বিত কোন উদ্যোগ নেওয়া হয় নি। এই প্রবন্ধে বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে এই অত্যাবশ্যকীয় কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
এরূপ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি সিস্টেম (বিডিইউএস) নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা ইউজিসি’র তত্ত্ববধানে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রযুক্তি নির্ভর একটি উচ্চ শিক্ষা প্লাটফরম থাকতে পারে যার মাধ্যমে একটি জাতীয় এলএমএস হোস্ট করে বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি ঐক্যবদ্ধ ডিজিটাল সিস্টেমের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। এই অটোমেটেড প্লাটফর্মের মূল কাজ হবে: (ক) একটি অন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য এলএমএস যেমন ক্যানভাস বা ব্ল্যাকবোর্ড এর লাইসেন্স নেওয়া এবং জাতীয় ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট এন্টারপ্রাইজের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় কাস্টমাইজ করা (খ) স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি হিসেবে বিডিইউএস এর ক্যাম্পাস কানেকশনের মাধ্যমে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের তালিকা সংরক্ষণ, শিক্ষার্থী ফি প্রদান, প্রাতিষ্ঠানিক ই-মেইল প্রদান, আর্থিক সহযোগিতা ও স্কলারশীপ, সেলফ সার্ভিস, শিক্ষার্থী রেজিস্ট্রেশন, গ্রেডিং, একাডেমিক রেকর্ড, ডিজিটাল ট্রান্সক্রিপ্ট, সার্টিফিকেট তৈরি প্রভৃতি অটোমেশনের অধীনে নিয়ে আসা (গ) শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতকরণে প্রযুক্তি নির্ভর আইকিউএসি (প্রাতিষ্ঠানিক মান নিশ্চিতকরণ সেন্টার) বা টিটিএডিএ (টিচিং ট্রান্সফরমেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট একাডেমি) সংযুক্ত করা যারা বিল্ট-ইন কোর্স টেমপ্লেট/নির্দেশনামূলক নকশা, মূল্যায়ন রুব্রিক, শিক্ষক উন্নয়ন মডিউল এবং একাডেমিক এক্রিডিটেশনের সরঞ্জাম প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন করবে (ঘ) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডিটিটাল শিক্ষাদান ও বিষয়বস্তুর উপর প্রশিক্ষণ মডিউল প্রস্তুত করা (ঙ) ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ, প্রতিবেদন এবং অন্যান্য প্রক্রিয়ায় সংগৃহিত ডেটা বিশ্লেষণ করা (চ) দূরবর্তী শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন শিক্ষণ সহায়তা ও ডিজিটাল বিভাজন দূর করার জন্য মোবাইল-বান্ধব প্ল্যাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে সমতা ও অ্যাক্সেস নিশ্চিত করা, প্রভৃতি।
বিডিইউএস প্লাটফরম এবং ইউনিক এলএমএস পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যায়ক্রমিক যে কাজগুলো করা দরকার তাহলোঃ (১) সম্ভাব্যতা যাচাই ও অংশীজনের পরামর্শ গ্রহণ (২) প্লাটফর্ম প্রস্তুত ও কাস্টমাইজ করা এবং এলএমএস লাইসেন্সিং গ্রহণ (৩) প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও স্টাফদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পাইলট প্রকল্প গ্রহণ (৪) প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক সহায়তার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম গ্রহণ (৫) ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রাখা।
এই প্লাটফরম যেভাবে কাজ করবে তাহলোঃ (১) মন্ত্রণালয়/ইউজিসি নীতি, তহবিল, জাতীয় ডেটা তত্ত্বাবধান প্রদান করবে (২) বিডিইউএস ম্যানেজমেন্ট অফিস স্থাপনের মাধ্যমে এলএমএস লাইসেন্স পরিচালনা, ইউএমএস (ইউনিভার্সিটি ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম) মডিউল কাস্টমাইজ করার মাধ্যমে নিরাপত্তা এবং সার্ভার রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করবে (৩) কেন্দ্রীয় এলএমএস এর মাধ্যমে সমস্ত কোর্স, উপকরণ, শিক্ষার্থীর জমা, গ্রেড, আলোচনা ফোরাম, অনলাইন পরীক্ষা পরিচালনা করবে (৪) ইউএমএস (ইউনিভার্সিটি ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম) এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি, তালিকাভুক্তি, পরীক্ষার ফলাফল, ট্রান্সক্রিপ্ট তৈরি, সার্টিফিকেট যাচাইকরণ, এলএমএস এর সাথে সম্পূর্ণরূপে সমন্বিতভাবে পরিচালনা করবে (৫) আইকিউএসি বা টিচিং ট্রান্সফরমেশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (টিটিএডিএ) এর মাধ্যমে মান নিশ্চিতকরণ সূচকগুলি (পাসের হার, ঝরে পড়া, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ) পর্যবেক্ষণ করার জন্য সিস্টেম রিপোর্ট এবং শেখার বিশ্লেষণ অ্যাক্সেস করবে (৬) শিক্ষক উপকরণ এবং গ্রেড আপলোড করার মাধ্যমে যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গা থেকে যাতে শিক্ষার্থীরা অ্যাক্সেস করতে পারে সেটা নিশ্চিত করবে।
এখন আসা যাক বাজেটের বিষয়ে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও (পূর্বের হেকেপ ও বর্তমান হিট প্রজেক্টের মাধ্যমে যা এখনো চলমান রয়েছে) মাত্র কয়েক কোটি টাকার এই অটোমেশন কার্যক্রম গ্রহণ না করা আমাদের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। ইন্টারনেট ও সংশ্লিষ্ট এলএমএস পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান (ক্যানভাসের জন্য ইন্সট্রাকচার এবং ব্ল্যাকবোর্ডের জন্য এনথোনি) এর ওয়েবসাইট ও ইমেইল যোগাযোগের মাধ্যমে যতটুকু অবগত হয়েছি তাতে শিক্ষার্থী প্রতি বছরে ২০০০/৩০০০ টাকা (২০-২৫ ডলার) খরচ করলে বাংলাদেশ শিক্ষা প্রযুক্তির এই মহা সড়কে প্রবেশ করতে পারে। মজার বিষয় হচ্ছে এই সার্ভিস চার্জ শিক্ষার্থীরাই প্রদান করবে এবং এতে শিক্ষার্থীরা অনেক বেশী লাভবান হবে। সরকার বা প্রতিষ্ঠানের প্রারম্ভিক কিছু খরচ হলেও পরবর্তীতে বিনা খরচে আধুনিক প্রযুক্তির মহা সড়কে বিচরণ করবে নামমাত্র কিছু সার্ভিস চার্জ প্রদানের মাধ্যমে। জাতীয়ভাবে পরিচালিত এলএমএস এবং ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে বিনিয়োগ করে, বাংলাদেশ তার উচ্চশিক্ষা খাতকে আধুনিকীকরণ করতে পারে, উদ্ভাবনী শিক্ষাদান এবং শিক্ষণকে সমর্থন, এবং বিশ্বব্যাপী জ্ঞান অর্থনীতির জন্য প্রস্তুত গ্রাজুয়েট তৈরির ক্ষমতা জোরদার করতে পারে। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসিকে তাদের নেতৃত্বে এবং নির্দেশনায় এই অগ্রগামী চিন্তাভাবনামূলক প্রকল্পটি শুরু করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।
-লেখক শিক্ষা টেকনোলজি বিশেষজ্ঞ (ইউএসএ) ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক
কলাম সম্পাদনাঃআমিনুল ইসলাম
২২৯ বার পড়া হয়েছে